Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

টাঙ্গাইল জেলার বিখ্যাত গুণীজন

আবদুল হালীম খাঁ : প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য টাংগাইলকে এক বিশেষ ঐশ্বর্য দান করেছে। উত্তর ও পূর্বে প্রাচীন লালমাটির উঁচু ভূমির ধ্যানমগ্ন পাহাড়। তার মধ্যে নানা উপজাতি লোকের বিচিত্র জীবন যাপন, গজারী, গামার, কড়ি, মেহগনি বৃক্ষরাজির সারি অনন্তকাল যাবত নামাজের জামায়াতে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে সমতল ভূমি, তার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ছোট ছোট অাঁকা বাঁকা নদী। পশ্চিমদিকে দুরন্ত যৌবনা বিশাল যমুনা নদী। নদীর মধ্যে মধ্যে অসংখ্য নতুন নতুন চর। চর তো নয় যেনো দুধের সর। সেখানে কূলে কূলে শিশুদের খেলা ঘরের মতো নিত্য নতুন নতুন ঘরবাড়ি নতুন জীবন। এ যেনো প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে বিজয়ী মানুষের উড্ডীন রাঙা পতাকা। ছোট্ট একটি ছড়ায় বিধৃত হয়েছে টাংগাইলের ছবি ঃ

নদী চর খালবিল গজারির বন

টাংগাইল শাড়ি তার গরবের ধন।

ছড়াটি এভাবেও বলা হয় ঃ

চমচম টমটম গজারির বন

টাংগাইল শাড়ি তার গরবের ধন।

টাংগাইলের চমচমের নাম শুনলে কার জিভে পানি না আসে! আর টাংগাইল শাড়ি কোন নারীর মন না ভুলায়? শুধু চমচম আর শাড়িই নয়, বাংলা কাব্য সাহিত্য শিক্ষা সংস্কৃতি ও রাজনীতির অঙ্গনে টাঙ্গাইলের গর্ব করার মতো অনেক অসংখ্য প্রতিভাবান ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন, যাদের নিরলস শ্রম ত্যাগ সাধনা ও সংগ্রামে জাতি ধাপে ধাপে উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে। ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে তাদের নাম। জাতি তাদের কখনো ভুলবে না।

উল্লেখ্য, মোমেনশাহী জেলার অন্তর্গত টাঙ্গাইল মহকুমাকে ১৯৬৯ সালের ১ ডিসেম্বর টাংগাইলকে বাংলাদেশের ১৯তম জেলা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এ জেলার উপজেলা সংখ্যা ১১টি, আয়তন- এক হাজার তিনশ' নয় বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৮শ' ৫৭ জন।

এ জেলাতেই জন্মগ্রহণ করেছেন আলেম-উদ-দহর (জ্ঞান সমুদ্র) নামে খ্যাত আল কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক মৌলবী নঈম উদ্দীন (১৮৩২-১৯০৮ ইং)। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত বাংলার দুর্দশাগ্রস্ত মুসলিম সমাজ দেহের শিরায় শিরায় প্রাণশক্তি দান করে যে মহান মনীষী সারাজীবন বিরামহীন সাধনায় জীবনপাত করেন তিনি মৌলবী মুহাম্মদ নঈমউদ্দীন। তিনি ছিলেন এক ক্ষণজন্মা কীর্তিমান পুরুষ। কীভাবে মুসলিম সমাজকে আবার সঠিক ইসলামে ফিরিয়ে আনা যায়, কীভাবে তাদের সব কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্ত করা যায়, কীভাবে তারা আবার দুনিয়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে, এই ভাবনায় তিনি প্রকৃত কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান অর্জনের জন্য এবং দেশের মানুষের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন দীর্ঘকাল। অতঃপর তিনি জাতির সেবায় সাহিত্য সাধনার পথ বেছে নেন। অল্পদিনের মধ্যে টাংগাইলের করটিয়ার মতো অজপাড়াগাঁয়ে ইসলাম প্রচার, সমাজসেবা, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার এক শক্তিশালী প্রাণকেন্দ্র গড়ে তোলেন। তিনি পেয়ে যান কিছুসংখ্যক নিবেদিত প্রাণ সাহিত্যকর্মী ভক্ত ও সমাজসেবক। সমকালীন মুসলিম সাহিত্যিকদের তিনি ছিলেন মধ্যমণি। এবং সবার উৎসাহদাতা।

মৌলবী নঈমউদ্দীন ছিলেন প্রকৃত ইসলামী চিন্তাবিদ, সুসাহিত্যিক ইসলাম প্রচারক, সমাজ সংস্কারক, সুবক্তা এবং মানবপ্রেমিক। মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম বাংলায় কুরআন শরীফ অনুবাদ করে অক্ষয় গৌরব অর্জন করেছেন। এ জন্য তিনি মুসলিম সমাজে চিরকাল অসীম শ্রদ্ধায় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। একশ' বছর পূর্বে অবিভক্ত বাংলার জ্ঞানরসহীন বিশাল মরুভূমিতে কী অপরিসীম প্রাণাবেগে ও আকাঙ্ক্ষায় বক্তৃতা দিয়ে ঝড়ের মতো দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন ভাবতে আজ অবাক লাগে। তখন যোগাযোগ ও ভ্রমণ কত যে কষ্টকর ছিল, সেই সময়ে করটিয়া থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বার্মা সিলেট, সিলেট থেকে রংপুর, তারপর কলকাতা, তারপর কলকাতা থেকে আসাম, বিহার আর দার্জিলিং ছিল তার হাতের তলা যেনো। করটিয়া থেকে তিনি প্রকাশ করেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিখ্যাত পত্রিকা আখবারে ইসলামিয়া। এই আখবারে ইসলামিয়া কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সারাদেশে প্রচারিত হতো। তিনি বুখারী শরীফেরও অনুবাদ করেন। এছাড়াও তিনি আরো অনেক গ্রন্থ রচনা করেন।

মৌলবী নঈমউদ্দীনের এক ভক্ত ছিলেন বিশিষ্ট জ্ঞানতাপস সাধক সমাজ সংস্কারক সাংবাদিক ও লেখক রিয়াজউদ্দীন আহমদ আল মাশহাদী। তিনি ‘অগ্নি কুক্কুট' গ্রন্থ রচনা করে প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি মিহির, নবযুগ, নবরত্ন প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগেও কাজ করেন।

প্রথম মুসলমান মহিলা কবি ছিলেন করিমুননিশা খানম (১৮৪১-?) তাঁর দু'খানা কাব্য প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন পূর্ববাংলার এক সময়ের মন্ত্রী নওয়াব বাহাদুর স্যার আবদুল করিম গজনভী ও তাঁর ছোট ভাই স্যার আবদুল হালীম গজনভীর মা।

মাওলানা আহমদ আলী আকালুভী (১৮৬৪-১৯৬০ ইং) ছিলেন ইসলাম-প্রচারক, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, সুবক্তা এবং প্রখ্যাত কবি।

তিনি ছিলেন দারুণ তেজোদীপ্ত সৎসাহসী সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তিনি বালাকোট জিহাদসহ আরো কয়েকটি জিহাদে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের পরিচয় দেন। তিনি খিলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মাওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা আবদুল্লাহিল বাকী, মাওলানা ইসলামাবাদীদের সহকর্মীরূপে টাংগাইল জিলার আঞ্জুমনে-ওলামায় বাংলার প্রচার ও সংগঠনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বালাকোট জিহাদে অংশগ্রহণ করার কারণে সমাজে তিনি গাজী হিসাবে সুপরিচিত ও সম্মানিত ছিলেন।

আকিকুন নিসা (যিনত) (১৮ই পৌষ ১৩২২-১৩৮৯ বাংলা) ছিলেন তাঁর সময়ে মহিলাদের মধ্যে রূপে ও গুণে উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন মাওলানা আহমদ আলী আকালুভীর কন্যা এবং এক সময়ের মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের স্ত্রী। তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটি গ্রন্থ-১. ‘আধুনিকা স্ত্রী' ও ২. ‘আধুনিক স্বামী' সে সময়ের জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত গ্রন্থ। সে সময়ে সওগাত অফিসে পুরুষদের পাশাপাশি যে সকল মহিলা লেখিকা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন আকিকুননিসা যিনত ছিলেন তাঁদের মধ্যমণি।

বাংলাদেশের শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজসেবা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সুষ্ঠু ধারা বিকাশে যিনি আপ্রাণ চেষ্টা ও সাধনা করেচেন তিনি ধনবাড়ির বিখ্যাত জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯ ইং)। তিনি ছিলেন মুসলিম বাংলার অগ্রগতির প্রাণ পুরুষ। তাঁর   কর্ম তৎপরতা ছিল অবিভক্ত বাঙলার সর্বত্র। নওয়াব আলী চৌধুরী তৎকালীন বাংলার শাসন পরিষদ ও ভাইসরয়ের আইন পরিষদ সদস্য, আসাম ও বঙ্গীয় আইন পরিষদ সদস্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অবিস্মরণীয়। তিনিই সর্ব প্রথম বাংলাভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা করার লিখিত দাবি জানান তৎকালের ভারত সরকারের কাছে। তিনি মুসলমান লেখক ও সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তিনি বেঙ্গল ফেডারেশন গঠন করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ছিলেন। রাজনীতিবিদ ছাড়াও তিনি ছিলেন কবি ও উচ্চমানের সাহিত্যিক। তৎকালীন বাংলার শিক্ষা উপদেষ্টার পদে থেকে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার রচিত অনেকগুলো গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-ভার্নাকুলার এডুকেশন অব বেঙ্গল, মৌলুদ শরীফ এবং ঈদুল আযহা ইত্যাদি।

যুধীষ্ঠির দাশ (জন্ম আনুমানিক ঊনিশ শতকের শেষ দশকে) ছিলেন একজন বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক। তিনি কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারক।

ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন (১৮৯৫-১৯৯১) ছিলেন আরবী ভাষায় পন্ডিত, গবেষক, শিক্ষাবিদ এবং বহু গ্রন্থ প্রণেতা।

দক্ষিণা রঞ্জণ মজুমদার (১৮৭৭-?) ছিলেন একজন বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক। তার শিশু সাহিত্য বিষয়ক বইগুলো পাঠক প্রিয়তা লাভ করেছিল।

বিসু মিয়া, অনেকের কাছে বিসু ডাকাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন নলুয়ার অধিবাসী। তিনি ছিলেন সমাজসেবক, স্বদেশপ্রেমিক ও ফকির আন্দোলনের নেতা।

ড. সতীশ চন্দ্র দাশ গুপ্ত (১৮৯২-?) ছিলেন সুসাহিত্যক, সুপন্ডিত, গবেষক এবং হরিজন আন্দোলনের নেতা।

এসএম আসলাম তালুকদার (মান্না) (১৯৫০-২০০৮ ইং) প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নায়ক, নাট্যকার ও গায়ক ছিলেন।

এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা বিস্তার এবং জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য যারা আপ্রাণ চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম করে গেছেন করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (১৮৭১-১৯৩৬ ইং) ছিলেন তাদের অন্যতম প্রাণ পুরুষ। পন্নী পরিবার এদেশের এক পুরাতন ও মর্যাদাবান জমিদার পরিবার। ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর ডাক নাম ছিল চাঁদ মিয়া। তার দান-দক্ষিণা, দয়া ধর্মের কথা দেশে কিংবদন্তীর মতো ছড়িয়ে আছে। তার জমিদারিতে প্রজা পীড়ন ছিল না। বাকি খাজনার জন্য নালিশ ছিল না। তাঁর প্রজা বিলি জমিনের বিঘার আয়তন ছিল সবচেয়ে বড় আর খাজনা ছিল সবচেয়ে কম। প্রজাদের শিক্ষার জন্য করটিয়াতে স্কুল ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার আলীগড় নামে সুখ্যাত করটিয়া সাদত কলেজ (বর্তমানে সরকারি) তিনি প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ইবরাহিম খাঁ ছিলেন সাদত কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। এ কলেজেই তিনি দীর্ঘ বাইশ বছর প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। ওয়াজেদ আলী খান পন্নী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। তার কর্মকান্ডে মোমেনশাহী জিলার মধ্যে করটিয়া অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের এক বৃহৎ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। গান্ধী বিলাতী জিনিসপত্র বর্জনের যে ডাক দিয়েছিলেন সে ঢেউ করটিয়া এসে লেগেছিল। চাঁদ মিয়া সাহেব খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এজন্য তিনি বৃহৎ জমিদারির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করেননি। সারা ভারতে জমিদারদের মধ্যে তিনি প্রথম এই আন্দোলনে অকুতোভয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এজন্য তিনি দীর্ঘদিন কারাভোগও করেছেন।

আমাদের এ বাংলাদেশ, তথা তৎকালীন আসামের পশ্চিম প্রান্তের মাটিতে এমনভাবে মিশে আছে যে, এ মাটি সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলেই আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কীর্তির কথা ওঠে আসে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি ছিলেন সকল মানুষের নেতা, এদেশের সকল রাজনৈতিক নেতাদের গুরু। এদেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানো, স্বাধীনতার সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন ফারাকা সমস্যা এবং জাতীয় জীবনে সকল সমস্যায় তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। বানে-ঝড়ে সামুদ্রিক জলোচ্ছবাসে ক্ষতিগ্রস্ত ও মহামারিতে আক্রান্ত মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে তিনি সবার আগে চলে গেছেন। তিনি ছিলেন স্বদেশপ্রেমিক মানবতাবাদী, এক কথায় তিনি ছিলেন বিশ্বপ্রেমিক। দরিদ্র অসহায় কৃষক শ্রমিক মজুর বেকার ভাসমানদের তিনি ছিলেন বন্ধু একান্ত আপনজন। মাওলানা ভাসানীর জীবন ও সংগ্রামের পরিধি ছিল বিশাল, উপলব্ধি ছিল অনেক গভীর এবং দূরদৃষ্টি ছিল সুদূর প্রসারী। সেই অতীতের খেলাফত আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান আন্দোলন, পাকিস্তানের সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামসহ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দেশ ও জাতি সকল সমস্যায় তিনি মুরুববীর মতো দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি টাঙ্গাইল শহরের অনতিদূরে কাগমারিতে কলেজ স্থাপন করেছেন। সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। ঢাকার বুকে আবুজর গিফারী কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি সর্বতোভাবে সাহায্য করেছেন। তাতে হযরত আবুজর গিফারীর প্রতি এবং রাববানী দর্শনের প্রতি তার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। মাওলানা ভাসানী কেবল রাজনৈতিক জীবনেই আমাদের নেতা ছিলেন না, তিনি এক মহান দরবেশও ছিলেন। ইসলাম বলতে যে জীবন ব্যবস্থা বুঝায় তাকে তিনি সর্বতোভাবে তার জীবনে রূপায়নের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তিনি শরীয়ত ও মারিফতের মধ্যে কোন ভেদ রেখা টেনে আনেননি। উভয়কেই যথাযোগ্য মর্যাদা দান করেছেন এবং এদেশীয় মুসলিম জীবনকে প্রকৃত ইসলামী জীবন যাপন করার জন্য আজীবন তাগিদ করেছেন। মাওলানা ভাসানী আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক অমর উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।

এ উপমহাদেশে যে কয়জন ক্ষণজন্মা মনীষী জন্মগ্রহণ করেছেন প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ তাদের মধ্যে অন্যতম। এদেশের রেনেসাঁর যুগে তার জন্ম ছিল আরো বেশি অর্থবহ। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, সুসাহিত্যিক, সমাজসেবক, সমাজ সংস্কারক ও রাজনীতিবিদ। তিনি তৎকালীন অনগ্রসর মুসলিম সমাজে শিক্ষা বিস্তারের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বৃটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী। তার উদ্যোগে মোমেনশাহী ও করটিয়াতে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের বিরাট কেন্দ্র গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর তিনি তার রাজনীতিকে নিয়ে আসেন সাহিত্য সমাজসেবা ও শিক্ষাঙ্গনে। মূলত তিনি ছিলেন একজন অনন্য সমাজ রূপকার। সমৃদ্ধ একটি সমাজ গঠনই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। এই সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তিনি বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষা ও সাহিত্যকে। সততা ও মহত্বের বড় সুন্দর প্রকাশ ঘটেছিল ইবরাহীম খাঁর মধ্যে। প্রকৃত অর্থে সৎ ও মহৎ বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। সারা জীবনই তিনি দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন এবং মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। গ্রামের নিরক্ষর মানুষের প্রতি ছিল তার অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসা। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ সকল মানুষের প্রকৃত বন্ধু। তাঁর সাহিত্য জুড়ে রয়েছে গ্রামবাংলার অবহেলিত বঞ্চিত অতি সাধারণ মানুষের কথা।

তৎকালে বাংলার মুসলমান কোথায় খোঁজ করতে হলে হালক্ষেতের পর যেতে হতো জেলখানায়, ফৌজদারি এজলাসে, আদালতে পিওন-চাপরাশি মহলে, জমিদারের পাইক-পেয়াদার আড্ডায় আর রেলস্টেশনে, যেখানে দেখা যেতো মহাজন দিয়ে উৎখাত হওয়া শত শত নিঃস্ব চাষী ছেঁড়া কাঁথা, ভাঙা চাটাই, নেংটা ছেলেপুলে আর হাহাকারে ফেটে পড়া মা, স্ত্রী, কন্যা নিয়ে আসামে জঙ্গলের দিকে চলছে।

বাংলার মুসলমানদের এমন দুর্দিনে ইবরাহীম খাঁ তাদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য ডাক দিয়েছিলেন। তারা সেই ডাক শুনে ফিরে দাঁড়ালো। তারা আবার ফিরে এসে সেই চাল চুলোহীন ভিটেমাটিতে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখতে লাগলো।

তিনি করটিয়ার দানবীর জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর আর্থিক সহযোগিতা ও উৎসাহে প্রতিষ্ঠা করলেন করটিয়া সা'দত কলেজ। বর্তমানে এটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। এ কলেজে তিনি দীর্ঘ বাইশ বছর প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে ইবরাহীম খাঁ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডে প্রেসিডেন্ট রূপে যোগদান করে পাঁচ বছর এ পদের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। তাঁর জন্মভূমি ভূইয়াপুরে স্থাপন করেন বালক উচ্চ বিদ্যালয়, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং ভূঁইয়াপর কলেজ। বর্তমানে এটি ইবরাহীম খাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। এখানেই তিনি স্থাপন করেছেন একটি ফাজিল মাদরাসা, থানা, সাবরেজিস্ট্রী অফিস, পশু হাসপাতাল, হাসপাতাল, কাজী অফিস, ক্লাব, পাঠাগার, ফিসারী অফিসসহ আরও অনেক সরকারি-বেসরকারি অফিস। টাঙ্গাইল থেকে ভূঁইয়াপুর সড়কটি তারই প্রচেষ্টায় নির্মিত হয়েছে। ভূঁইয়াপুর বর্তমানে একটি নিটোল সুন্দর এক টাউন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামেও রয়েছে তাঁর অনেক অবদান।

অবিভক্ত বাংলা আসাম বিহারের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলমান প্রিন্সিপাল। জাতীয় পরিষদ সম্মেলনে লুঙ্গিকে এদেশের জাতীয় পোশাক ঘোষণার দাবি জানিয়ে ছিলেন। বিদ্রোহীও বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ বাংলা সাহিত্যে অমর অবদান। তিনি একশত আঠারো খানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত ‘বাতায়ন' এর মাধ্যমে তিনি তাঁর সমসাময়িক কালকে অমর করে রেখেছেন। আমাদের জাতীয় জাগরণে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর ত্যাগ ও সাধনা তরুণ সমাজ কর্মীদের জন্য চিরকাল প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তিনি ১৮৯৮ ইং সালে ভূইয়াপুরের পাশের গ্রাম শাহবাজ নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৬ সালের ২৯ মার্চ ঢাকা পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

আবদুল হামিদ চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৬৮) ছিলেন সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ, পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের স্পিকার, বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার। প্রতুল চন্দ্র সরকার পিসি সরকার নামে খ্যাত। তিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত যাদু সম্রাট এবং যাদু বিদ্যা সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচয়িতা। সিরাজউদ্দীন চৌধুরী ছিলেন প্রখ্যাত সনেটিয়ার। লোকমান হোসেন ফকির ছিলেন কবি, গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী। তাঁর কয়েকটি কবিতা ও গানের বই রয়েছে।

আর.পি সাহা (১৮৯৬-১৯৭১) দানবীর ও সমাজসেবী। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী মহিলা কলেজ ও কুমুদিনী হাসপাতালের জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন। ড. আলীম আল রাজী (১৯২৫-১৯৮৫) লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও আইন শাস্ত্রে পিএইচডি এবং বার এ্যাট ল ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন সমাজসেবী এবং সুলেখক। আইন শাস্ত্রের উপর তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রয়েছে।

ড. এমএন হুদা (১৯১৯-১৯৯১ইং) প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, মন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন। হাসান আলী চৌধুরী (১৯১০-১৯৮৫) সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদ ছিলেন। খুররম খান পন্নী ছিলেন করটিয়ার জমিদার নন্দন। তিনি পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (১৯২১-১৯৮৭) ছিলেন আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে বিশ্বের জনমত সৃষ্টি করেন এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

বেগম ফজিলাতুন্নেসা (১৮৯৯-১৯৭৭) গণিতে এমএ পরীক্ষায় (১৯২৭) প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। নিখিল বঙ্গে তিনিই প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট এবং উপমহাদেশে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রথম বিলাত থেকে ডিগ্রি এনেছিলেন। শিক্ষাবিদ হিসাবে তিনি সেকালে মুসলিম সমাজে স্বনামধন্য ছিলেন।

করটিয়া সরকারি সাদত কলেজে তাঁর নামে একটি ছাত্রীবাস রয়েছে। উল্লেখিত ব্যক্তিদের ছাড়াও টাঙ্গাইলে আরো অনেক কবি সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক ব্যক্তি রয়েছেন। তাদের বিশেষ কয়েকজন হচ্ছেন- হাতেম আলী খান, আবদুল হামিদ খান ইউসুফজাই, শামছুল হক, কৃষ্ণ কুমার মিত্র, কৃষ্ণ দয়াল বসু, জাহাঙ্গীর খান ইউসুফজাই, তারাপদ রায়, মফিজ-উল-হক, তুষার কান্তি ঘোষ, বিজয় সরকার, দেবেন চন্দ্র ভট্টাচার্য, রোস্তম আলী তরফদার, ড. কেটি হোসেন, সাযযাদ কাদির এবং আরো অনেক।